ষোল বছরের নিমরার ঘুমটা কয়েক মুহূর্ত আগেই ভেঙ্গে গিয়েছিল একটা ভারতীয় মিসাইলের শব্দে। বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। পা যেন আর নড়ছিল না নিমরার।
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে নিমরাদের বাড়ির কয়েক মিটার দূরের মসজিদে ততক্ষণে আঘাত করেছে ওই ভারতীয় মিসাইলটা। চোখের সামনেই সে দেখেছিল যে মসজিদের একটা মিনার ভেঙ্গে পড়েছে মিসাইলের আঘাতে। আঘাত যে ওর নিজের বুকেও লেগেছে, সেটা বুঝতেই পারে নি নিমরা।
বিবিসিকে নিমরা বলছিলেন, আমার খালা তো আঁতকিয়ে উঠেছিল। আমার জামায় তখন রক্ত। আসলে জামার রঙটা ছিল সাদা আর গোলাপী, কিন্তু ততক্ষণে জামাটা যেন কেউ লাল রঙে চুবিয়ে দিয়েছে। আমি আগে কখনো দেখি নি এরকম।
নিমরার কথায়, আমিও দৌড়চ্ছিলাম, কিন্তু পুরো সময়টা বুকে একটা হাত চেপে রেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল হাতটা সরালে ভেতর থেকে সবকিছু বেরিয়ে আসবে। পরে জানা গিয়েছিল যে ওর হৃদপিণ্ডের খুব কাছে একটা ধারালো টুকরো গেঁথে গেছে।
এর কয়েক ঘণ্টা পরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পাকিস্তান যে গোলাবর্ষণ শুরু করেছিল, তা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চে অন্য একটি পরিবার।
সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ৭২ বছর বয়সী এমএন সুধান বিবিসিকে বলছিলেন, যখন গোলাগুলি শুরু হয়, তখন সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়চ্ছিল- শিশুরা ভয়ে তাদের বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। কয়েকটি পরিবার গাড়িতে করে জম্মুর উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাবো। কিন্তু আমরা রওনা হওয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে একটি শেল এসে পড়ল আমাদের গাড়ির খুব কাছে। ধারালো টুকরোগুলো গাড়ির ভেতরে ছিটকে এসেছিল। আমার নাতি ওখানেই মারা যায়।
তার কথায়, আমরা তো সব হারালাম, দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর তো কিছুই রইল না আমাদের। আমি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে দুটি যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু এত তীব্র গোলাবর্ষণ আগে কখনো দেখি নি।
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে তীব্রতম সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গিয়েছিলেন যে গ্রামবাসীরা, নিমরা আর বিহান তাদের মধ্যেই দুজন।
বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার কথা অস্বীকার করেছে দুই সরকারই, তবে ওই অঞ্চলে বিবিসির সংবাদদাতারা খোঁজ নিয়েছেন সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যাওয়া পরিবারগুলোর।
কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার দু দিকেরই অনেক মানুষই বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, তাদের প্রিয়জনকে যেমন হারাতে হয়েছে, তেমনই ক্ষতি হয়েছে সম্পত্তিরও। ভারতের দিকে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে আর পাকিস্তান দাবি করেছে যে ৪০ জন বেসামরিক মানুষের প্রাণ গেছে। তবে এটি নিশ্চিত করা যায় নি যে সরাসরি গোলার আঘাতে ঠিক কতজন মারা গেছেন।
বিহানের দাদু সুধান বলছিলেন, আগে থেকে তো সতর্ক করা হয় নি যে বাড়ির ভিতরে থাকতে হবে বা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে! আগে থেকে কেন আমাদের জানানো হলো না? আমরা, সাধারণ মানুষরা তো গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলাম।
ভারত সরকার সম্ভবত আগে থেকে সাধারণ মানুষকে এলাকা খালি করতে বলেনি এই কারণে যাতে সামরিক হামলার বিষয়টা গোপন রাখা যায়।
তবে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু এপ্রিল মাসে পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পরেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সাধারণ মানুষকে গ্রামের বাঙ্কারগুলো পরিষ্কার করে রাখতে বলেছিলেন। ভারত যেদিন প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল, তার পরের দিনই দুই দেশের তরফেই ড্রোন হামলা শুরু হয়ে যায়। এরপরেই নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারতের দিক থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে দিতে শুরু করে সরকার।
সেদিনই রাত নটা নাগাদ ভারত শাসিত কাশ্মীরের উরির বাসিন্দা খান পরিবার ঠিক করে যে তাদেরও বাড়ি ছাড়তে হবে। বেশিরভাগ প্রতিবেশীই ততক্ষণে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় একটি গোলা থেকে ছুটে আসা ধাতব টুকরো ৪৭ বছরের নার্গিসের গায়ে বিঁধে যায়। তার আরেক আত্মীয় হাফিজাও গুরুতর আহত হন। গাড়ি নিয়ে তারা সোজা চলে যায় কাছের হাসপাতালে। কিন্তু দেখা যায় হাসপাতালের দরজায় তালা দেওয়া।
হাফিজা বলছিলেন, আমি কোনমতে হাসপাতালের পাঁচিল টপকিয়ে ভেতরে গিয়ে সাহায্য চাই। ওদের বলি যে আমাদের সঙ্গে আহত মানুষ আছেন। তখন একজন এসে দরজা খোলে। গোলাবর্ষণের ফলে ডাক্তাররা ভয় পেয়ে গিয়ে সব বন্ধ করে ভেতরে বসেছিলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
পাকিস্তানের যে তিনটি বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায় ভারত, তারই মধ্যে অন্যতম ছিল রাওয়ালপিন্ডির বিমান ঘাঁটিও। ওই শহরেই পাকিস্তানের সেনা সদর দফতর।
পাকিস্তানী সামরিক অফিসার বলছিলেন, সীমারেখাটা সেদিনই অতিক্রম করা হয়েছিল।
পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ভারতীয় সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। অন্যদিকে কূটনৈতিক স্তরে চলছিল চূড়ান্ত ব্যস্ততা।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলছেন, একের পর এক বৈঠক, সমন্বয়, নানা দেশ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এবং তারপরে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করা হচ্ছে, তারাও আবার ফোনে কথা বলছেন অন্য দেশের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব বা ইরান – যে কোনও দেশই মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিলে আমরা স্বাগত জানাই যাতে উত্তেজনা প্রশমন করা যায়।
ওদিকে ততদিনে, পহেলগামে ২২ শে এপ্রিলের হামলার পর থেকেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর অন্তত ১৭ জন বিশ্ব নেতা এবং কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন। এইসব বিশ্ব নেতাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্যের বিদেশ সচিব ডেভিড ল্যামি এবং রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।
এই সব আলোচনা নিয়ে জয়শঙ্কর যেসব টুইট করেছেন, তাতে তিনি জানিয়েছিলেন যে ‘সীমান্ত পারের উগ্রপন্থী হামলা’র ওপরে যেমন জোর দেওয়া হয়েছে, তেমনই পহেলগামের হামলার মূল চক্রীদের নির্দিষ্টভাবে দায়ী করতে চেষ্টা চালানো হয়েছে।
দুই তরফে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরেই সেই শনিবার বিকেলেই কূটনৈতিক সাফল্য আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন যে পর্দার আড়ালে মার্কিন মধ্যস্থতাকারীরা এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব সহ আঞ্চলিক শক্তিগুলির কূটনৈতিক মধ্যস্থতা উত্তেজনা প্রশমনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা বলছিলেন, আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেকটা ভেতরে সেদেশের কৌশলগত স্থাপনাগুলোতে আঘাত করতে পেরেছি দেখেই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।
দুই দেশের এই সর্বশেষ সামরিক অভিযানের শুরুটা যেখানে, সেই পহেলগামের হামলাকারীদের খোঁজ এখনও চলছে।
পেহেলগামের হামলায় নিহত ভারতীয় নৌবাহিনীর ২৬ বছর বয়সী অফিসার বিনয় নারওয়াল সেখানে গিয়েছিলেন মধুচন্দ্রিমা সারতে। হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন।
হামলার পর নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী স্বামীর দেহের পাশে বসে আছেন, এমন একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়েছে। নারওয়ালের দাদু হাওয়া সিং নারওয়াল হত্যাকারীদের ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ চান।
তিনি বলছিলেন, এই সন্ত্রাসের অবসান হওয়া উচিত। আজ আমি আমার নাতিকে হারালাম। আগামীতে অন্য কেউ তার প্রিয়জনকে হারাবে।
ছবির মতো সুন্দর কাশ্মীরে পর্যটন নিয়ে সরকার যে ব্যাপক প্রচার করছিল, তার মধ্যেই পেহেলগামের ওই হামলা ভারতের সরকারকে প্রবল ধাক্কার মুখে ফেলে দিয়েছে।
ভারত সরকারের একটি সূত্র বলছে, কাশ্মীর নিয়ে পর্যটকদের উৎসাহ দেখে আমরা বোধহয় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে চড়াইটা পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু আমরা ভুল ভেবেছিলাম। চার দিনের এই সংঘাত আবারও দেখিয়ে দিল দুই দেশের মধ্যে শান্তি কতটা ভঙ্গুর হতে পারে। সূত্র: বিবিসি বাংলা